বীরকন্যা প্রীতিলতা ; ব্রিটিশ ভারতে প্রথম নারী শহিদের রক্তাক্ত আখ্যান।
বিপ্লবের অগ্নিযুগ। চারদিকে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। ভারতমাতার মুক্তির সংগ্রাম। চলছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ।রাতের সমুদ্র গর্জনে মিশে যাচ্ছে বুলেট শব্দ। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এক নারী বিপ্লবীর নেতৃত্বে আক্রমণ করা হলো চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব। আক্রমণ শেষে হুইসেল বাজালেন নেতা। হঠাৎ পিছন থেকে একটি বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পরলেন।নিজের জীবনের পরুয়া না করে পটাশিয়াম সায়েনাইড খেয়ে মৃত্যু তরান্নিত করলেন। তিনি ব্রিটিশভারতে প্রথম নারী শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
লেখক পুর্ণেন্দু দস্তিদারের সাথে প্রীতিলতার ঘনিষ্ট সান্নিধ্য থাকায় ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ বইটিতে সহজ সাবলীল ভাষায় লেখক বয়ান করেছেন প্রীতিলতা কীভাবে বীর প্রীতিলতা হয়ে উঠলেন।বইটি ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।বইয়ের ভূমিকায় কবি সুফিয়া কামাল শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করে বলেন- বীরকন্যার আত্মদানে বাংলাদেশ মহিমান্বিত।প্রীতিলতার জীবন পাঠে আমাদের নারীরা প্রেরণা লাভ করবে।
চট্টগ্রামের এক হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রীতিলতার জন্ম। তার ডাক নাম রানী। ছোট বেলা থেকেই পড়াশুনায় মেধাবী।স্কুল জীবনেই এক আত্মীয় দাদার সংস্পর্শে বিপ্লবের প্রতি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন।এ আগ্রহ হতেই তার সাথে আলাপ হয় বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ মাস্টার দা সূর্য সেনের। মাস্টারদার সান্নিধ্য তার জীবন গভীরভাবে পালটে দেয়।তখন সমগ্র ভারতবর্ষ একদিকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন অন্যদিকে বিপ্লবীদের সসস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আদায়ের প্রয়াস।প্রীতিলতা যুক্ত হলেন চট্টগ্রামে বিপ্লবী দলের সাথে।ঢাকার ইডেন কলেজে আইএ পড়ার সময় লাভ করলেন মহিয়সী লীলা নাগের সাহচর্য। কলকাতার বেথুন কলেজে দর্শন শাস্ত্রে বিএ পড়ার সময় তিনি আরো উদগ্রীব হয়ে উঠলেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে।তখন বিপ্লবী দলে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিলো না।রানী জেদ ধরলেন।মরিয়া হয়ে উঠলেন প্রাণের মাতৃভূমিকে স্বাধীনতার পরশ দিতে।তার এ পথ ছিলো কঠিন, সে কথা ভেবেই হয়তো তার বাঁশিতে কখনো কখনো রাতের নীরবতায় করুণ সুর বাজতো।
তাঁর এক কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘আঁধার পথে দিলাম পাড়ি /মরণ-স্বপন দেখে।’
কলকাতা থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে চলে আসলেন চট্টগ্রামে। চাকরি নিলেন একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে। মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট,জালালাবাদ পাহাড়ে সম্মুখ যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত,নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্য প্রীতিলতার বিপ্লবী জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। জালালাবাদ পাহাড়ে ১২ জন শহিদ যুদ্ধার রক্তের বদলা নিতে তিনি অধীর হয়ে উঠলেন। বারবার পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণে বিপ্লবীদের ব্যর্থতা,প্রীতিলতার একাগ্রতা,নিষ্ঠা,দেশপ্রেম ইত্যাদি কারণে মাস্টারদা নারী হলেও প্রীতিলতাকে পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণের অনুমতি দেন। শুরু হয় চট্টগ্রামের কাট্টলী গ্রামে দলের প্রশিক্ষণ।ব্রিটিশ রক্ত চক্ষুর বিরুদ্ধে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির আন্দোলনে পাহাড়তলী ক্লাবে বিপ্লবীদের আক্রমণে প্রায় ৫৩ জন ইংরেজ নরনারী নিহত হয়। প্রীতিলতা বুলেটে রক্তাক্ত হয়ে পটাসিয়াম সায়েনাইড খেয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।পুরুষের ছদ্মবেশে পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণের সশস্ত্র নেতৃত্ব ব্রিটিশদের শাসন যন্ত্রের ভীত কাঁপিয়ে দেয়। প্রেরণা যোগায় ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের।‘বীরনারী প্রীতিলতা’ বইটিতে এমনি করেই এক বীর নারীর গল্প উঠে এসেছে। যা আমাদের সব সময় প্রেরণা যোগাবে।
শিশির রাজন
লেখক ও বইপড়া আন্দোলনের কর্মী।
Sheshir.rajan@gmail.com