‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ একটি সহজিয়া জীবনী গ্রন্থ
‘মৃত্যুর চেয়ে জীবন অনেক বড়,
এ কথা সবাই জানে;
কিন্তু কখনো মৃত্যুও বড় হয়-
জীবনের শেষ দানে।’
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক গোলাম সামদানী কোরায়শী’র ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ একটি সহজিয়া জীবনী গ্রন্থ। এই গ্রন্থের প্রতিটি পৃষ্ঠায় উঠে এসেছে বাংলার মহামানব জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনা সমূহ। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের নানা দিক প্রত্যক্ষভাবে স্থান পেয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থের কাঠামো বিন্যাসে। প্রিয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি আমরা কখন এবং কিভাবে পেলাম তার একটি সরল বর্নণা স্থান পেয়েছে বইটির শুরুতেই। রাজনীতি কী? অধিকার কী? সাম্প্রদায়িকতা কী? এই তিনটি গুরুত্বপূণ্য বিষয়ের একটি সরল আলোচনা গ্রন্থটিকে আরো বেশি সময় উপযোগী করে তুলেছে।
আমাদের এই দেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা পরাধীন ছিলেন। ১৭৫৭ সালে সেই যে পলাশীর আমবাগানে বাংলার যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ঠিক সেখান থেকে প্রায় ২০০ কি: মি: দূরে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাংলার রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। টুঙ্গিপাড়া এ দেশের একটি সাধারণ গ্রাম। সবুজ গাছপালা আর খোলা মাঠের মাঝে বাড়ি-ঘর। আলো হাওয়ার উদার হাতছানি। এমনি এক পরিবেশে বেড়ে উঠতে লাগলেন ‘খোকা’।
গোপালগঞ্জে তখন স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছে। আন্দোলনের এই সূত্র ধরে একদিন এক জনসভায় পুলিশ লাঠিচার্জ করল। শ্রোতা হিসেবে শেখ মুজিব সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। পুলিশের এই আচরণে কিশোর মুজিব খুবই ক্ষুদ্ধ হলেন। এর ফলে বিক্ষোভকারী একদল তরুণ যখন থানায় ঢিল ছুড়তে এগিয়ে গেল, তখন শেখ মুজিবও ঢিল হাতে সেই তরুণদের মধ্যে মিশে গেলেন। সেই থেকে শুরু- ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালের ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভ, ১৯৫০ সালের ভুখা মিছিল, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের জন্য জেল জীবন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে- আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ১৯৭১ সালের মহানস্বাধীনতা যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার লৌহমানব জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ঐতিহাসিক এই সালগুলোর সাথে চিরদিন বঙ্গবন্ধুর নামটি অমর হয়ে থাকবে সমস্ত বাঙালির হৃদয়ে। গ্রন্থের ইতিহাস বয়ানে সহজ এবং সরল ভাবে এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
বাংলার স্বাধীকার আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে ১৮ বার জেলে গেছেন, সর্বমোট ১১ বছর জেলে কাটিয়েছেন। সেই থানার দিকে ঢিল ছুড়ে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন আর ‘বাকশাল’ নামক একটি প্রকাণ্ড ঢিল ছুড়ে তিনি সেই জীবনের ইতি টানলেন। তাঁর স্বায়ত্তশাসনের দাবি হয়ে গেলো- স্বাধীনতা। কে জানে তাঁর এই ‘বাকশালে’র একদলীয় শাসনও একদিন রুপ নিতে পারে- সমাজতন্ত্রে। কাজেই এবার বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার যড়যন্ত্র দানা বাঁধতে আরম্ভ হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সেই টুঙ্গিপাড়ায়, যেখানে তিনি জন্মেছিলেন শৈশব কাটিয়েছিলেন, সেখানে তাঁকে নিয়ে গিয়ে কবর দেয়া হলো। তবে এ কথা ঠিক যে ঘাতকেরা তাঁকে হত্যা করতে পারেনি, তাঁর নশ্বর দেহটাকেই শুধু দূরে সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বাংলার কোটি কোটি সাধারণ মানুষের অন্তরে চিরদিন তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ রুপে বিরাজ করবেন।
কবি কামাল চৌধুরী তাঁর কবিতায় লিখেছেন-
‘যেখানে ঘুমিয়ে আছো, শুয়ে থাকো
বাঙালির মহান জনক
তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ
শৌর্য আর অমিত সাহস
টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে আমাদের গ্রামগুলো
তোমার সাহস নেবে।
নেবে ফের বিপ্লবের দুরন্ত প্রেরণা।’
বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক গোলাম সামদানী কোরায়শী’র ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ একটি সুপাঠ্য জীবনী ও ইতিহাস গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে এবং পঞ্চম প্রকাশ এপ্রিল ২০১৩ সালে।প্রচ্ছদ ও বই নকশা করেছেন- দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান। মূল্য- ৩৩ টাকা মাত্র। পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৪৮। আমি আশা করি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ‘আলোর পাঠশালা’র পাঠকদের এই বইটি দ্বীপান্বিত করবে।