গোরা
01:24 AM 05/09/2020
Rating : 10/10
উনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছিলেন একটি বৃহৎ উপন্যাস গোরা। গোরা এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। গোরা প্রধান তবে পরিপূর্ণ না । এখানে বিভিন্ন চরিত্র যেমন বিনয়, পরেশবাবু, আনন্দময়ী, সুচরিতা, ললিতা, হরিমোহিনী, হারানবাবু, বরদাসুন্দরীর মতো আরো বেশ কিছু চরিত্র আছে। প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে একটি স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। স্বকীয়তা থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের কাছে সমর্পিত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসেই কথা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের রূপ গুণ স্বভাব কিছুই মেলে না, তবু তো সেজন্যে দুই মানুষের মিলনে বাধে না- আর, মত বিশ্বাস নিয়েই- বাধবে কেন?” গোরা উপন্যাসটির চরিত্র গুলোর বিভিন্ন মতের দ্বন্দ্ব একটা দার্শনিক রূপ লাভ করেছে। এখানে স্থান পেয়েছে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, নারীবাদ , সার্বজনীনতা, প্রেম, মুক্তি। উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেমন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়েছে ঠিক সেভাবেই পাঠকের চিন্তা চেতনা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের জীবনে সমাজ পরিবার প্রেম যে প্রভাব বিস্তার করে এবং যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তার সুন্দর সমাধান উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাসে লিখেছেন, “দুঃখের সময় পৃথিবীর অনেক বড়ো জিনিস অনেক ভালো জিনিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। দুঃখের এই একটি গৌরব এবার বুঝেছি। দুঃখের সান্ত্বনা যে ঈশ্বর কোথায় কত জায়গায় রেখেছেন তা সব সময় জানতে পারি নে বলেই আমরা কষ্ট পাই।” গোরা উপন্যস পড়লে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাজ আর ধর্মের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সুন্দর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । মানুষ অজ্ঞতাবশত সমাজ এবং ধর্মকে খুব সহজেই মিলিয়ে ফেলে। কিন্তু দুইটি বিষয় যে বেশ ভিন্ন তা এই উপন্যাস পড়লে বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না। এখানে ধর্ম কে মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস বলা হয়েছে এবং ধর্মকে কোনো সমাজের সাথে জড়িত করা উচিত না। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি, “ ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তির উপরে ধর্ম নয়, ধর্মের ভিত্তির উপরেই ব্যক্তি ও সমাজ। সমাজ যেটাকে চায় সেইটাকেই যদি ধর্ম বলে মানতে হয় তা হলে সমাজের মাথা খাওয়া হয়। সমাজ যদি আমার কোনো ন্যায়সংগত ধর্মসংগত স্বাধীনতায় বাধা দেয় তা হলে সেই অসংগত বাধা লঙ্ঘন করলেই সমাজের প্রতি কর্তব্য করা হয়।” গোরা উপন্যাসের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের খুব জোড়ে সড়ে চেষ্টা চালিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা বিভিন্ন মতবাদ সম্প্রদায়বাদ সমাজবাদ করতে যেয়ে আমরা খুব সুন্দরভাবে বাদ দিয়ে দিয়েছি সার্বজনীনতা আর মানবিকতা। আমার মনে হয় ভুলেই গেছি যে আমরা মানুষ আমাদের হৃদয় আছে আমাদের হৃদয়ে সকল মানুষের জন্য সকল সৃষ্টির জন্য প্রেম আছে। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের আনন্দময়ীর গোরা প্রাপ্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন “মানুষ বস্তুটি যে কত সত্য- আর মানুষ যা নিয়ে দলাদলি করে, ঝগড়া করে মরে, তা যে কত মিথ্যে” সত্য মানুষকে মুক্তির স্বাদ গ্রহণের সুয়োগ করে দেয়। আমরা সম্প্রদায় কে ধর্ম ভেবে ভুল করে মুক্তির বদলে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। ধর্ম ভেবে ভুল হয় বলেই আমাদের হৃদয় নির্মল না হয়ে ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। তার থেকেই সৃষ্টি হয় বর্বরতা। আর এই কথা বোঝাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ মতকে মত দিয়ে, যুক্তিকে যুক্তি দিয়েই বাধা দেওয়া চলে, কিন্তু বুদ্ধির বিষয়কে ক্রোধ দিয়ে দণ্ড দেওয়া বর্বরতা” কট্টর হিন্দুত্ববাদি গোরা কত সুন্দরভাবে সে তার মুক্তির পথ পেয়ে গেলো। একটি সত্য তার জীবনে যাকে সে পাপ মনে করতো তা এক মুহুর্তে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসের পরেশবাবুর মাধ্যমে বলে উঠলেন, “সত্যকে যখন পাই তখন সে তার সমস্ত অভাব- অপূর্ণতা নিয়েও আমাদের আত্মাকে তৃপ্ত করে- তাকে মিথ্যা উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তোলবার ইচ্ছামাত্র হয় না।” আর সেই কট্টরপন্থি গোরা নির্মল চিত্তে পরেশবাবু নামক রবীন্দ্রনাথের নিকট হাত জোর করে বললেন, “আপনার কাছেই এই মুক্তির মন্ত্র আছে- সেইজন্যেই আপনি আজ কোনো সমাজেই স্থান পান নি। আমাকে আপনার শিষ্য করুন। আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই; যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে- কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না- যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা...!
